যুদ্ধের হুঙ্কার বনাম বাস্তবতা: ভারতের সামরিক শক্তির সামনে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
যুদ্ধের হুঙ্কার বনাম বাস্তবতা: ভারতের সামরিক শক্তির সামনে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে?
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে আজকাল প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশের কিছু অতি-উৎসাহী মানুষ বা কট্টরপন্থী গোষ্ঠী ভারতের বিরুদ্ধে "যুদ্ধের" ডাক দিচ্ছেন। কেউ কেউ তো পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ মিলে ভারতকে সামরিকভাবে কোণঠাসা করে ফেলার স্বপ্নও দেখছেন। আবেগের বশে স্লোগান দেওয়া সহজ, কিন্তু যুদ্ধের ময়দান সম্পূর্ণ ভিন্ন। আধুনিক যুদ্ধ সাহসের চেয়েও বেশি নির্ভর করে প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং ভূ-কৌশলগত অবস্থানের ওপর।
একজন ভারতীয় হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, আসুন দেখি ভারতের সামরিক শক্তির সামনে এই তথাকথিত "যৌথ বাহিনী"র হুঙ্কার আসলে কতটা হাস্যকর।
১. পরিসংখ্যানের আয়নায় শক্তির ব্যবধান
বিশ্বখ্যাত সামরিক বিশ্লেষণ সংস্থা Global Firepower Index (2025) অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের ৪র্থ শক্তিশালী সামরিক শক্তি। সেখানে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের ধারেকাছেও নেই। নিচের ছকটি দেখুন:
| সামরিক সক্ষমতা | ভারত (India) | পাকিস্তান (Pakistan) | বাংলাদেশ (Bangladesh) |
|---|---|---|---|
| গ্লোবাল র্যাংক (২০২৫) | ৪র্থ (বিশ্বশক্তি) | ৯ম | ৩৭তম |
| প্রতিরক্ষা বাজেট | ~$৭৫ বিলিয়ন+ | ~$৭.৬ বিলিয়ন | ~$৪.৩ বিলিয়ন |
| মোট যুদ্ধবিমান | ২২০০+ (Rafale, Su-30MKI) | ১৪০০+ (F-16, JF-17) | ২০০+ (পুরানো মিগ ও এফ-৭) |
| এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার | ২টি (INS বিক্রান্ত ও বিক্রমাদিত্য) | ০ (নেই) | ০ (নেই) |
| বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ | ~$৬৫০ বিলিয়ন+ | ~$১০-১৫ বিলিয়ন (ঋণগ্রস্ত) | ~$২০ বিলিয়ন (সংকটপূর্ণ) |
| যুদ্ধের স্থায়িত্ব | দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালাতে সক্ষম | ৭-১০ দিনের বেশি রসদ নেই | ৭ দিনের বেশি রসদ নেই |
(সূত্র: Global Firepower Index 2025 ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিবেদন)
২. আকাশ ও সমুদ্রের একচ্ছত্র আধিপত্য
- আকাশপথ: ভারতের হাতে রয়েছে Rafale এবং Sukhoi-30 MKI-এর মতো অত্যাধুনিক 4.5 জেনারেশনের ফাইটার জেট এবং S-400 মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। পাকিস্তানের সাহায্য আসার আগেই ভারতীয় বায়ুসেনা আকাশসীমা দখলে নিতে সক্ষম।
- সমুদ্রপথ (Game Changer): বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌবাহিনী অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভারতের দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং নিউক্লিয়ার সাবমেরিন পুরো সাগর নিয়ন্ত্রণ করে। যুদ্ধের পরিস্থিতি হলে ভারত সহজেই বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলো 'ব্লক' বা অবরুদ্ধ করে দিতে পারে। এতে তেল ও বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে গেলে অর্থনীতি ধসে পড়তে সময় লাগবে মাত্র কয়েক দিন।
৩. পাকিস্তান কি আসলেই সাহায্য করতে পারবে?
অনেকে পাকিস্তানের সহায়তার আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো:
- ১৯৭১ সালে পাকিস্তান তাদের নিজেদের অংশকেই (পূর্ব পাকিস্তান) ভারতের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি।
- ভারত ও পাকিস্তানের মাঝখানে ২,০০০ কিলোমিটারের দুর্ভেদ্য ভারতীয় ভূখণ্ড।
- পাকিস্তানের নিজের ঘরেই অর্থনৈতিক আগুন জ্বলছে। ভারতের মতো বিশাল শক্তির সাথে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর মতো বিলাসিতা দেখানোর সাধ্য তাদের নেই।
৪. 'চিকেন'স নেক' ভ্রান্তি ও পরিণাম
শিলিগুড়ি করিডোর বা 'চিকেন'স নেক' বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেওয়া আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা সমান। ভারত এই এলাকাকে সর্বোচ্চ সামরিক নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছে। তাছাড়া, ভারত যদি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা সীমান্ত বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তবে তার মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামলানো ঢাকার পক্ষে অসম্ভব হবে।
যারা যুদ্ধের ধুয়া তুলছেন, তাদের জন্য একটি ভ্রাতৃত্বসুলভ পরামর্শ— ভারতের সাথে শত্রুতা করে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত লাভবান হতে পারেনি। ভারতের সামরিক শক্তি কাউকে আক্রমণ করার জন্য নয়, বরং আত্মরক্ষার জন্য।
যুদ্ধের আবেগ বাদ দিয়ে নিজেদের বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য এবং অস্থিতিশীলতা দূর করার দিকে মনোযোগ দেওয়াই হবে প্রকৃত দেশপ্রেম। মনে রাখবেন, হাতির সাথে পিঁপড়ার লড়াই গল্পে মানায়, বাস্তবে নয়।

Comments
Post a Comment